বইপোকা

 ঢাকা শহরের বইপোকাদের কাছে বইয়ের স্বর্গ মানেই হলো নীলক্ষেত কিংবা বাংলাবাজার। অনেক ঢাকাবাসীর তো এ-ও বিশ্বাস যে নীলক্ষেত বা বাংলাবাজারের চেয়ে বড় বইয়ের বাজার বুঝি হতেই পারে না। কিন্তু তাদের জন্য বড় ধরনের একটি চমক অপেক্ষা করে রয়েছে প্রতিবেশী কলকাতাতেই। সেখানে গিয়ে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, "দাদা, খুব রেয়ার কিছু বই খুঁজছিলাম। কই পাব বলুন তো!" মুহূর্তের মধ্যেই পেয়ে যাবেন ঝটিতি জবাব, "কেন, কলেজ স্ট্রিট!"

  

কলেজ স্ট্রিট নিয়ে এমন প্রবল আত্মবিশ্বাসের পেছনে বেশ যুক্তিসঙ্গত কিছু কারণ রয়েছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই সড়ক পৃথিবীর বুকে বাংলা বইয়ের বৃহত্তম বাজার। আয়তনে এটি সম্মিলিতভাবে নীলক্ষেত ও বাংলাবাজারের চেয়েও বড়। শুধু কি তাই! এটি ভারতের বৃহত্তম বইয়ের বাজার, এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরনো বইয়ের বাজার। 

  

কলেজ স্ট্রিট সম্পর্কে বেশ চমৎকার একটি মিথ প্রচলিত রয়েছে: আজ পর্যন্ত নাকি পৃথিবীর কোনো ছাপাখানাতেই এমন কোনো বই ছাপা হয়নি, যার অন্তত একটি কপি আপনি কলেজ স্ট্রিটে খুঁজে পাবেন না। এ যে নিছকই অতিকথন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরও একটিবার কলেজ স্ট্রিট ধরে হেঁটে বেড়ানোর পর আপনাকে স্বীকার করতেই হবে, বইপ্রেমীদের জন্য এর চেয়ে শ্রেয়তর জায়গা সম্ভবত আর কিছুই হতে পারে না। 

  

অন্তত ভারতীয় পাঠকদের রুচি ও চাহিদার সাথে মেলে, কলেজ স্ট্রিটে খুঁজেও পাবেন না এমন বইয়ের জুড়ি মেলা ভার। তাই তো ২০০৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনের "বেস্ট অফ এশিয়া" তালিকায় ভারতের উল্লেখযোগ্য স্থানের স্বীকৃতি পেয়েছে এই কলেজ স্ট্রিট। আর বছরখানেক আগে কলেজ স্ট্রিট পাড়া ঘুরে দেখা শেষে জনৈক মুগ্ধ, বিমোহিত, ফরাসি সাহিত্যপ্রেমী তো আবেগের আতিশয্যে বলেই বসেছিলেন, "মাইন ডি লিভার!" তার কথার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "বইয়ের খনি।"

  

আসলেই তো, খনি ছাড়া আর কী! সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে যেমন যতদূর চোখ যায় দেখা মেলে কেবল অনন্ত জলরাশির, কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে দাঁড়ালেও তেমন চোখের সামনে শুধু বইয়ের সমুদ্র। রাস্তার দুই ধারের ফুটপাতে থরে থরে সাজানো হাজার হাজার বই। বইয়ের কাঠামোগুলো মিলে যেন গড়ে তুলেছে হিমালয় পর্বতমালা। সেগুলোর ফাঁক দিয়ে হঠাৎ করেই যখন উঁকি মারতে দেখবেন দোকানির মুখ, তখন বুকটা ধক করে উঠতেই পারে!  

  

রাতের বেলা সোডিয়াম বাতি জ্বলে কলেজ স্ট্রিটে। সেই সোডিয়াম বাতির নিয়ন আলোয় আপনার চোখের সামনে যেন জীবন্ত হয়ে উঠবে সেইসব চরিত্র, যেগুলোকে এতদিন আপনি কেবল আপনার মনশ্চক্ষে হাঁটাচলা করতে দেখেছেন সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ কিংবা সুচিত্রা-শংকরদের বইয়ে। এবং বাস্তবিকই, ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক সাক্ষাৎ পুণ্যভূমি এই কলেজ স্ট্রিট। অনেকের মতে কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের 'দ্বিতীয় বাড়ি'-ও এটিই। 

  

ঠিক কবে, কখন বইয়ের বাজারের জন্য কলেজ স্ট্রিট সুখ্যাতি লাভ করে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। দাবি করা হয়, কলকাতার বইয়ের বাজার আগে ছিল চিতপুরে। তবে কীভাবে সেই বাজার কলেজ স্ট্রিটে চলে এলো? এ প্রশ্নের জবাব পেতে আগে জানতে হবে, কলেজ স্ট্রিট কীভাবে কলেজ স্ট্রিট হলো!

  

১৮১৭ সালে এই কলেজ স্ট্রিট এলাকা ঘিরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ, যা বর্তমানে পরিচিত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নামে। ওই একই বছর এই এলাকায় হিন্দু স্কুল, এবং পরের বছর স্থাপিত হয় হেয়ার স্কুল। এরপর একে একে ১৮২৪ সালে সংস্কৃত কলেজ, ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতের প্রথম মেডিকেল কলেজ, কলকাতা মেডিকেল কজেল ও হাসপাতালও গড়ে ওঠে এই এলাকাতেই। এভাবেই কলেজগুলোকে কেন্দ্র করে জায়গাটির নামই হয়ে যায় কলেজ স্ট্রিট। 

  

আর শুধু কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন, এগুলোকে কেন্দ্র করে ক্রমশ গড়ে ওঠে কফি হাউস, দিলখুশা কেবিন, বসন্ত কেবিন ইত্যাদিও। তবে সে যা-ই হোক, কথা হচ্ছিল কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের জন্য খ্যাতিমান হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে। এত এত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য আউট-বইয়ের জোগান দিতেই কলেজ স্ট্রিটে গড়ে উঠতে থাকে নানা বইয়ের দোকান। 

  

ইতিহাস বলছে, কলেজ স্ট্রিটের বুকে প্রথম যে বইয়ের দোকানটি গড়ে উঠেছিল, তার মালিক ছিলেন গুরুদাশ চট্টোপাধ্যায়। তবে নিজস্ব কোনো দোকান ছিল না তার। হিন্দু হোস্টেলের সিঁড়িতে মেডিকেল বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসতেন তিনি। এরপর ১৮৮৩ সালে গড়ে ওঠে এস কে লাহিড়ী অ্যান্ড কোম্পানি, এবং বছর তিনেক বাদে দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এখানে একটি বইয়ের দোকান খুলেছিলেন বলে জানা যায়, যার নাম সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি। এভাবেই ধীরে ধীরে, একের পর এক বইয়ের দোকান গড়ে ওঠে গোটা এলাকাজুড়ে। আর তারপর ছোট ছোট বালুকণা ও বিন্দু বিন্দু জল মিলে গড়ে তুলেছে কেমন মহাদেশ সাগর অতল, সে দৃষ্টান্ত তো আপনি দেখতেই পাবেন কলেজ স্ট্রিটে পা রাখলে।

  

বর্তমানে কলেজ স্ট্রিট কেবল বইয়ের প্রাপ্তিস্থান হিসেবেই প্রসিদ্ধ নয়, এখানকার বইপাড়ায় গড়ে উঠেছে সহস্রাধিক প্রকাশক ও বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে যে প্রতিষ্ঠানটি, তার নাম দে'জ পাবলিশিং। কলকাতার বাংলা বইয়ের বৃহত্তম প্রকাশক তারা, যাদের ক্যাটালগে রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি বইয়ের টাইটেল। ১৯৭০ সালে পথচলা শুরুর পর আসছে বছর সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তারা।

  

এছাড়াও কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় রয়েছে ১৯১০ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের তিন ছাত্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত "চক্রবর্তী, চ্যাটার্জি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড"। কলেজ স্ট্রিটের উপর একটি দ্বিতল ভবন নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে গ্রন্থবিপণীটি। এর নিচ তলায় রয়েছে পাঠ্যপুস্থক, আর উপরের তলায় পাওয়া যায় অন্য নানা ধরনের বই। ১৯৭৩ সাল থেকে তারা নিজেরাও নিয়মিত নানা ধরনের বই প্রকাশ করে আসছে।

  

আরো আছে বেঙ্গল পাবলিশার্স, যার প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত সাহিত্যিক মনোজ বসু। তার রচিত অনেক বইয়েরই প্রকাশক এই প্রকাশনী, যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য 'নিশুকুটুম্ব'। তবে সম্প্রতি এই প্রকাশনায় দেখা দিয়েছে মন্দা, যে কারণে সাম্প্রতিক কয়েক বছর নতুন বই প্রকাশ কিংবা বইমেলায় অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে তারা।

  

চমকপ্রদ বিষয় হলো, কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে কিন্তু শুধু বাংলা বই-ই প্রকাশিত হয় না। অবাঙালি ভাষার মধ্যে ইংরেজি ও হিন্দি নানা বই তো নিয়মিত প্রকাশিত হয়ই, এমনকি এখান থেকেই আলোর মুখ দেখে উর্দু, ওডিশি, অসমিয়া ভাষার নানা বইও। আর স্রেফ সাহিত্য কেন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য পাঠ্যপুস্তকও প্রকাশিত হয় এই কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া থেকেই।

  

পহেলা বৈশাখে কলেজ স্ট্রিট পরিণত হয় কলকাতার লেখকদের মিলনমেলায়। কেননা এদিন বিভিন্ন প্রকাশনী কলেজ স্ট্রিটে তাদের দপ্তরে আমন্ত্রণ করেন লেখকদের। বহু বছর ধরে চলে আসছে এই প্রথা, যা আজো একইভাবে বহাল রয়েছে। এছাড়াও সারা বছরই কলেজ স্ট্রিটে লেগে থাকে খ্যাত-অখ্যাত লেখকদের আনাগোনা। বিশেষ করে নবীন লেখকদের জন্য এ এক অন্যরকম তীর্থক্ষেত্র। নিজেদের লেখা পাণ্ডুলিপি নিয়ে তারা বারবার মাথা ঠোকেন এই কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের ঠাকুর তথা প্রকাশকদের কার্যালয়ে।

  

তবে এই মুহূর্তে ভালো নেই কলেজ স্ট্রিট। আগে থেকেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বই ব্যবসায়ীদের অবস্থা ছিল দুর্বিষহ। এবং সর্বশেষ গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে এসেছে ঘূর্ণিঝড় আমফানের তাণ্ডব। কলকাতার সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, বুধবার ঘণ্টায় ১৩০ কিমি বেগে বয়ে চলা প্রবল ঝড়-তুফানে নষ্ট হয়ে গেছে কোটি টাকার বই, আর চূড়ান্ত ক্ষতির শিকার হয়েছেন অগণিত প্রকাশক ও বই বিক্রেতা। কীভাবে এই ক্ষতি সামলে উঠবে কলেজ স্ট্রিট, সে প্রশ্ন এখন ঘুরছে পশ্চিমবঙ্গের আপামর বইপ্রেমীর মনে।

Comments

Popular posts from this blog

মায়ার শহর

কিভাবে বাংলাদেশ থেকে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করবেন

তুই আমার নেশা